আশীষ-উর-রহমান | তারিখ: ১৯-০৯-২০১০

আমাদের ষড়্ঋতুর দেশে শরৎ অন্য ঋতুগুলোর তুলনায় খানিক নিভৃতচারী বলেই মনে হয়। বসন্তের মতো তার চোখধাঁধানো রূপের বাহার নেই। গ্রীষ্মের মতো নেই ফলের সম্ভার কিংবা প্রচণ্ড দাবদাহ। শীতের মতো হাড় কাঁপিয়ে দেওয়ার পরাক্রম, দিগন্ত চরাচর ঢেকে ফেলা কুয়াশার ঘনঘোরও শরতের নেই। এমনকি বর্ষার মতো বাজবিজলির চমক, তুমুল ঝড়ঝাপটার সামর্থ্যও নেই তার। যদিও তারও বৃষ্টি আছে, কিন্তু সে বৃষ্টিতে মাঠের এপাশ ভেজে তো ওপাশ থেকে যায় শুকনো খটখটে। আসলে শরৎ নেহাতই নিরীহ ধরনের। তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব তেমন স্পষ্ট করে চোখে পড়ে না, অন্তত শহরাঞ্চলে তো নয়ই। দরদালানে আকাশ ঢেকে রাখা এই মহানগরে শরতের শোভা দেখার সুযোগ সামান্যই। উপায় নেই শাপলা ফোটা বিলের ধারে বা কাশফুলে ছেয়ে থাকা নদীর কিনারে দুদণ্ড বসে সময় কাটানোর। সাধারণভাবে এই মহানগরে শরৎ তাই বর্ষার প্রলম্বিত অংশ বলেই মনে হয়।
আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টির তোড় কমে এলে আকাশের দৃশ্যপট একসময় বদলে যেতে থাকে। ধূমল আকাশ তখন হয়ে ওঠে ময়ূরকণ্ঠী নীল। স্বচ্ছ। তাতে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায় শিমুল তুলোর মতো পেঁজা পেঁজা মেঘ। সূর্যের আলোর ঝলক লেগে সেই মেঘের কিনারগুলো চকচকে দ্যুতি ছড়িয়ে দেয় নীলাকাশে। সাদায়-নীলে-রুপালিতে পুরো আকাশপট তখন যেন জলরঙে আঁকা এক মনোরম ছবি। সেই শোভায় মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দমধুর হাওয়া...।’ আর শরতের পূর্ণিমাও বড় মনোমুগ্ধকর, ‘শরৎশশী’র খ্যাতি তাই আবহমান কালের।
শরৎ এক অমল ধবল ঋতু। তার সবকিছুই শুভ্র। আমাদের এখানে তুষারপাত হয় না। কিন্তু আছে শরৎ। শুভ্রতার যে স্নিগ্ধ, পবিত্র সৌন্দর্য, শরৎই তুলে ধরে সেই রূপ। নদীর বুকে রুপালি বালুর চর। তার ওপর হাওয়ায় মাথা দোলানো ঘন কাশবন। বিল-ঝিল ভরা অগণিত শাপলার হাসি। মাথার ওপর ভেসে থাকা সাদা মেঘের ছবি পড়েছে সেই কাকচক্ষু বিলের পানিতে। বাড়ির উঠানে ছড়িয়ে থাকা শিশিরভেজা শিউলি। সকালে-সন্ধ্যায় নাকে এসে ঝাপটা দিয়ে যায় শিউলি-সুরোভিত মৃদু হাওয়া। শরতের একসময় বেজে ওঠে ঢাক-ঢোল। শুরু হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। তাতে প্রকৃতিকে অনাবিল সফেদ করে তোলা শরৎ পায় এক বিশেষ মাত্রা। এমন স্নিগ্ধ ঋতু আর নেই আমাদের বর্ষচক্রে। সেই শরৎ এখন শুচিশুভ্র করে রেখেছে আমাদের দেশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন