যে যেভাবে দেখি
॥ মুস্তাফা জামান আব্বাসী ॥
পয়লা বৈশাখ শেষ। এবার বৈশাখী ভাবনাগুলোকে সংহত করি। বৈশাখী কি উড়ে যাওয়ার জন্য একটি দিনের মাতামাতি, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্দেশ্যহীন শহরের পথে হেঁটে চলা? তা কী করে হয়? এতগুলো লোক পথে বেরিয়েছে একেবারেই উদ্দেশ্যবিহীন, শুধু দিনটিকে উপভোগ করার জন্য। এর কোনো উদ্দেশ্য নেই, শুধু বেলুন নিয়ে হইচই? মেলা মানে মিলন, দু’টি প্রাণের, বহু প্রাণের। তা আর কে মনে রাখছে আজ।
জাপানিদের নববর্ষে গিয়েছি, ওরা বড় হিসাবি জাত, হিসাব ছাড়া নড়ে না। নববর্ষে আসল কাজটা করে বসে, তা হলো পুরনো বিবাদ মেটিয়ে ফেলা, বন্ধুত্বের নতুন খাতা খোলা। আমরা সেটি করি না। গলা ঝেড়ে পুরনো গান গাইতে বসি, ওই গানের মধ্যে প্রবেশ করি না, কোনো কিছুর মধ্যেই প্রবেশ করি না। যা কিছু সব গানে গানে, তাই গান শেষ হলে সব উড়ে যায়।
বলে চলেছি, বিরোধ মিটিয়ে ফেলুন। অন্তরের মালিন্য দূর করুন, দেশবাসীকে মুক্তি দিন। দেশবাসী বিরোধকে মোটেই ভালোবাসে না। তারা একে মনেপ্রাণে প্রত্যাখ্যান করেছে। দিন চলে গেলে ওই প্রত্যাখ্যান আপনাদের সাথে যাবে। আমাদের কথা শুনুন। দেশটাকে রক্ষা করেন। গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে ঘৃণা যাদের মধ্যে বসতি স্থাপন করেছে তাদের ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেন। সবার ভালোবাসা পাবেন, নইলে ঘৃণা সবাইকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।
ঘুড়ি উড়ানো ভালো, মিছিলে মিছিলে কিছু মিলনের গান গাওয়া ভালো। থাইল্যান্ডে ইন্দোনেশিয়ায় মুখোশ সংস্কৃতির বিকাশ দেখে এসেছি। সেগুলোও ভালো। আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা মুখোশ ভালোবাসে। বাঘ, ভালুক, সিংহ, প্যাঁচা, সাপ সবই আছে। এগুলো নিয়ে মিছিল বেরোলে বলার কিছু থাকে না। যারা পুরনো তারা বলেন, এগুলো আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়, মূর্তি বা মুখোশ আমাদের ছিল না, এগুলো আরোপিত। আরোপিত টিকবে না, মিডিয়ায় সারা দিন সারা রাত ধরে দেখানো হলেও সেগুলোর মূল্য হবে না। ঈমান-আকিদার সাথে ওগুলো যাবে না। সংস্কৃতি একটি নদীর মতো, তার প্রবাহকে নিজের ইচ্ছামতো চালানো যায় না। তাই ভালো হয় যদি আমাদের গ্রামের মানুষের সংস্কৃতিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়।
এমন কোনো সভা খুঁজে পাই না যেখানে সভ্যজনদের গান ছাড়া অভাজনদের গান গাওয়া হচ্ছে। সেখানে নেই ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, মারফতি, জারি গান। আরোপিত গান কয়েকজনের জন্য ভালো নিশ্চয়ই। মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়ায় শহুরে গানের শহুরে চল। দিনকতক এটি চলবে বৈকি। বাংলার আপামর জনতার গান লোকসঙ্গীত। কোনো টেলিভিশনে সেই গান গাওয়া হয়নি। কেন? আরোপিত সঙ্গীতের প্রাধান্য সেখানে। তোমার গান কিছুই নয়, আমরা যা দেবো সেটিই তোমাদের গান, এ মনোভাব টিকবে না। এটি পরাজিত হবে, এই আমার বক্তব্য।
পুরনো বক্তব্যে আবার। বিভাজিত জাতি কোনো কিছু অর্জন করতে সমর্থ হবে না। বারবার একই কথা বলছি। বিভাজিত হবেন না, কেউই জয়ী হতে পারবেন না। জাতির সব সমস্যায় সবাই মিলে বিচার করুন। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য যা, তাকেই গ্রহণ করুন। এটাই ফয়সালা। পশ্চিম বাংলায় সবচেয়ে বড় উৎসব কী? এক কথায় জবাব, দুর্গাপূজা। আমাদের এখানে বছরে দুটো ঈদ। কিছু বন্ধু চাইছেন ঈদের বদলে বৈশাখী উৎসব। ওদের ইচ্ছা বাংলাদেশে বৈশাখ হবে সবচেয়ে বড় উৎসব। মাল্টিন্যাশনালরা কোটি কোটি টাকা দিতে কার্পণ্য করেননি। এবার পশ্চিম বাংলার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করুন, এটা ওরা চায় কি না, উত্তর : না। ওরা দুর্গাপূজাকেই চায়। আবার বৈশাখের আবাহনেও ভাসিয়ে দিতে চায় পুরনোর জঞ্জাল, সেটা অন্যায় নয়। বাংলাদেশে বাস করে উল্টো চিন্তার উদ্ভাবকদের সাবধানী হতে হবে। আমাদের সংস্কৃতি প্রয়াস যেন মধ্যপথে বাধা না পায়। আমরা একই সাথে আধুনিক আবার একই সাথে ধর্মের প্রতি অনুগত। ধর্মকে অস্বীকার করলে হবে সঙ্ঘাত, যার কোনো সুস্থির সমাধান আমার জানা নেই। এখানে ঈদ বড় উৎসব হবে। বৈশাখীতেও মাতব আমরা আনন্দে। কোনো বিরোধ নেই। যারা অন্যায় চিন্তা করে তাদের সাথেই বিরোধ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক দিন ছিলাম, সেখানে উপভোগ করেছি ‘থ্যাংকস গিভিং’, যা সবাই পছন্দ করেন। এর সাথে নেই ক্রিসমাসের বিরোধ। আবার একটি গ্রুপ ক্রিসমাসের বিরুদ্ধে লেগেছে। তারা বলে, আমেরিকার আসল উৎসব হওয়া উচিত গ্রামীণ আবহাওয়া থেকে উদ্ভূত ‘থ্যাংকস গিভিং’। খ্রিষ্টানেরা বলছে তা হওয়ার নয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে বাধা দিলে তা হবে এক ধরনের লড়াই। লড়াইয়ের দরকার কী, দু’টিই থাকুক। বাংলাদেশেও তাই বিরুদ্ধবাদীদের অন্যায় চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে যখন বাড়াবাড়ি দেখি, তখন সহজেই বুঝি এরা কী চায়, এরা চায় আরেক আধিপত্য। এমনকি বৈশাখী ভাবনাতেও তারা উড়ে এসে জুড়ে বসতে চায়।
পয়লা বৈশাখের পরের দিন বৈশাখ উধাও। কোথায় পাঞ্জাবি, কোথায় বৈশাখী শাড়ি। আরেক বছরের জন্য তুলে রাখি। বৈশাখের চার-পাঁচ তারিখ চলে গেলে ওই মাসের আর হিসাব নেই। ধন্য বৈশাখপ্রীতি। নববৈশাখে ডাক্তারের আহ্বান, আব্বাসী সাহেব, আপনার হাই কোলেস্টেরলের জন্য ইলিশ অনুপযোগী, গরুর গোশতের মতোই ওটি পরিহার করুন। এ বছর আর পান্তা-ইলিশ খাওয়া হয়নি। আগামী বছরের কথা বলতে পারি না।
লেখক : সঙ্গীত-সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
পয়লা বৈশাখ শেষ। এবার বৈশাখী ভাবনাগুলোকে সংহত করি। বৈশাখী কি উড়ে যাওয়ার জন্য একটি দিনের মাতামাতি, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্দেশ্যহীন শহরের পথে হেঁটে চলা? তা কী করে হয়? এতগুলো লোক পথে বেরিয়েছে একেবারেই উদ্দেশ্যবিহীন, শুধু দিনটিকে উপভোগ করার জন্য। এর কোনো উদ্দেশ্য নেই, শুধু বেলুন নিয়ে হইচই? মেলা মানে মিলন, দু’টি প্রাণের, বহু প্রাণের। তা আর কে মনে রাখছে আজ।
জাপানিদের নববর্ষে গিয়েছি, ওরা বড় হিসাবি জাত, হিসাব ছাড়া নড়ে না। নববর্ষে আসল কাজটা করে বসে, তা হলো পুরনো বিবাদ মেটিয়ে ফেলা, বন্ধুত্বের নতুন খাতা খোলা। আমরা সেটি করি না। গলা ঝেড়ে পুরনো গান গাইতে বসি, ওই গানের মধ্যে প্রবেশ করি না, কোনো কিছুর মধ্যেই প্রবেশ করি না। যা কিছু সব গানে গানে, তাই গান শেষ হলে সব উড়ে যায়।
বলে চলেছি, বিরোধ মিটিয়ে ফেলুন। অন্তরের মালিন্য দূর করুন, দেশবাসীকে মুক্তি দিন। দেশবাসী বিরোধকে মোটেই ভালোবাসে না। তারা একে মনেপ্রাণে প্রত্যাখ্যান করেছে। দিন চলে গেলে ওই প্রত্যাখ্যান আপনাদের সাথে যাবে। আমাদের কথা শুনুন। দেশটাকে রক্ষা করেন। গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে ঘৃণা যাদের মধ্যে বসতি স্থাপন করেছে তাদের ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেন। সবার ভালোবাসা পাবেন, নইলে ঘৃণা সবাইকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।
ঘুড়ি উড়ানো ভালো, মিছিলে মিছিলে কিছু মিলনের গান গাওয়া ভালো। থাইল্যান্ডে ইন্দোনেশিয়ায় মুখোশ সংস্কৃতির বিকাশ দেখে এসেছি। সেগুলোও ভালো। আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা মুখোশ ভালোবাসে। বাঘ, ভালুক, সিংহ, প্যাঁচা, সাপ সবই আছে। এগুলো নিয়ে মিছিল বেরোলে বলার কিছু থাকে না। যারা পুরনো তারা বলেন, এগুলো আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়, মূর্তি বা মুখোশ আমাদের ছিল না, এগুলো আরোপিত। আরোপিত টিকবে না, মিডিয়ায় সারা দিন সারা রাত ধরে দেখানো হলেও সেগুলোর মূল্য হবে না। ঈমান-আকিদার সাথে ওগুলো যাবে না। সংস্কৃতি একটি নদীর মতো, তার প্রবাহকে নিজের ইচ্ছামতো চালানো যায় না। তাই ভালো হয় যদি আমাদের গ্রামের মানুষের সংস্কৃতিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়।
এমন কোনো সভা খুঁজে পাই না যেখানে সভ্যজনদের গান ছাড়া অভাজনদের গান গাওয়া হচ্ছে। সেখানে নেই ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, মারফতি, জারি গান। আরোপিত গান কয়েকজনের জন্য ভালো নিশ্চয়ই। মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়ায় শহুরে গানের শহুরে চল। দিনকতক এটি চলবে বৈকি। বাংলার আপামর জনতার গান লোকসঙ্গীত। কোনো টেলিভিশনে সেই গান গাওয়া হয়নি। কেন? আরোপিত সঙ্গীতের প্রাধান্য সেখানে। তোমার গান কিছুই নয়, আমরা যা দেবো সেটিই তোমাদের গান, এ মনোভাব টিকবে না। এটি পরাজিত হবে, এই আমার বক্তব্য।
পুরনো বক্তব্যে আবার। বিভাজিত জাতি কোনো কিছু অর্জন করতে সমর্থ হবে না। বারবার একই কথা বলছি। বিভাজিত হবেন না, কেউই জয়ী হতে পারবেন না। জাতির সব সমস্যায় সবাই মিলে বিচার করুন। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য যা, তাকেই গ্রহণ করুন। এটাই ফয়সালা। পশ্চিম বাংলায় সবচেয়ে বড় উৎসব কী? এক কথায় জবাব, দুর্গাপূজা। আমাদের এখানে বছরে দুটো ঈদ। কিছু বন্ধু চাইছেন ঈদের বদলে বৈশাখী উৎসব। ওদের ইচ্ছা বাংলাদেশে বৈশাখ হবে সবচেয়ে বড় উৎসব। মাল্টিন্যাশনালরা কোটি কোটি টাকা দিতে কার্পণ্য করেননি। এবার পশ্চিম বাংলার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করুন, এটা ওরা চায় কি না, উত্তর : না। ওরা দুর্গাপূজাকেই চায়। আবার বৈশাখের আবাহনেও ভাসিয়ে দিতে চায় পুরনোর জঞ্জাল, সেটা অন্যায় নয়। বাংলাদেশে বাস করে উল্টো চিন্তার উদ্ভাবকদের সাবধানী হতে হবে। আমাদের সংস্কৃতি প্রয়াস যেন মধ্যপথে বাধা না পায়। আমরা একই সাথে আধুনিক আবার একই সাথে ধর্মের প্রতি অনুগত। ধর্মকে অস্বীকার করলে হবে সঙ্ঘাত, যার কোনো সুস্থির সমাধান আমার জানা নেই। এখানে ঈদ বড় উৎসব হবে। বৈশাখীতেও মাতব আমরা আনন্দে। কোনো বিরোধ নেই। যারা অন্যায় চিন্তা করে তাদের সাথেই বিরোধ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক দিন ছিলাম, সেখানে উপভোগ করেছি ‘থ্যাংকস গিভিং’, যা সবাই পছন্দ করেন। এর সাথে নেই ক্রিসমাসের বিরোধ। আবার একটি গ্রুপ ক্রিসমাসের বিরুদ্ধে লেগেছে। তারা বলে, আমেরিকার আসল উৎসব হওয়া উচিত গ্রামীণ আবহাওয়া থেকে উদ্ভূত ‘থ্যাংকস গিভিং’। খ্রিষ্টানেরা বলছে তা হওয়ার নয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে বাধা দিলে তা হবে এক ধরনের লড়াই। লড়াইয়ের দরকার কী, দু’টিই থাকুক। বাংলাদেশেও তাই বিরুদ্ধবাদীদের অন্যায় চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে যখন বাড়াবাড়ি দেখি, তখন সহজেই বুঝি এরা কী চায়, এরা চায় আরেক আধিপত্য। এমনকি বৈশাখী ভাবনাতেও তারা উড়ে এসে জুড়ে বসতে চায়।
পয়লা বৈশাখের পরের দিন বৈশাখ উধাও। কোথায় পাঞ্জাবি, কোথায় বৈশাখী শাড়ি। আরেক বছরের জন্য তুলে রাখি। বৈশাখের চার-পাঁচ তারিখ চলে গেলে ওই মাসের আর হিসাব নেই। ধন্য বৈশাখপ্রীতি। নববৈশাখে ডাক্তারের আহ্বান, আব্বাসী সাহেব, আপনার হাই কোলেস্টেরলের জন্য ইলিশ অনুপযোগী, গরুর গোশতের মতোই ওটি পরিহার করুন। এ বছর আর পান্তা-ইলিশ খাওয়া হয়নি। আগামী বছরের কথা বলতে পারি না।
লেখক : সঙ্গীত-সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
সুখে-দুঃখে, বর্ষায়-খরায়, দিনে-রাতে মুখ তুললেই যার মুখোমুখি, কে সে? মেঘ ছাড়া সে আর কেউ নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’—সে সঙ্গী আসলে জন্ম থেকে মৃত্যু, প্রতি মুহূর্তের। শুধু মানুষ নয়, সমগ্র জীবজগৎ, এই সসাগরা পৃথিবীর ওপরে সে নিজেকে প্রসারিত করে দিয়েছে পরম আশীর্বাদের মতো।
পাইকারি দরে পোশাক নিতে চট্টগ্রাম থেকে গত মঙ্গলবার বিকেলে পুরান ঢাকার চকবাজারের লিজা ফ্যাশনে এসেছিলেন তিন খুচরা বিক্রেতা। এর আগে দুটি চালান নিয়ে গেছেন এখান থেকে। সেসব বিক্রি শেষ। তৃতীয় চালান নিতে এসে দেখলেন, মহাজনের ঘরেই মালামাল নেই। এর কারণ প্রচুর বিক্রি নয়। আসলে এবার চকবাজারসহ পুরান ঢাকার পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোদমে উৎপাদনই করতে পারেনি। কারণ, বিদ্যুতের সংকট।
এক বছর পর আবার ফিরে এল সেই চেনা দৃশ্য। সকাল থেকেই হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফুটপাতের চায়ের দোকানগুলোর ঝাঁপ বন্ধ, নয়তো পর্দা দিয়ে ঘেরা। দেখা যায়নি খানাপিনা করতে, কিংবা প্রকাশ্যে ধূমপান। সংযত সবাই। বাড়িতেও নিত্যদিনের রুটিনের পরিবর্তন। সকালে চা-নাশতার পর্ব নেই। চাকরিজীবীরা প্রাতরাশ না করেই কর্মস্থলমুখী হয়েছিলেন গতকাল বৃহস্পতিবার। পবিত্র মাহে রমজান প্রথম দিন থেকেই বদলে দিয়েছে মানুষের প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনযাত্রা। সারা দিন পানাহারে বিরত থেকে, আত্মসংযমের সাধনার মধ্য দিয়ে পরম করুণাময় মহান আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের আশায় রোজা রাখা শুরু করেছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা।
রাতারাতি বদলে গেল ঢাকার নসিব। এ যেন মেঘ না চাইতেই বর্ষণেরও অধিক। মোগল সাম্রাজ্যের প্রান্তবর্তী বাংলা সুবার রাজধানীর মর্যাদায় আসীন হলো বঙ্গতিলোত্তমা ঢাকা নগরী। তবে এখন থেকে এর নাম হবে জাহাঙ্গীরনগর। বাংলা সুবার ভূতপূর্ব সুবাদার জাহাঙ্গীর কুলি খান অকস্মাত্ ইন্তেকাল করায় শেখ আলাউদ্দীন ইসলাম খান চিশতির ওপর এই সুবার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল। নানাবিধ সংঘাত-ব্যাঘাতে যাত্রাপথে নতুন সুবাদারের দুই বছর বিলম্ব হয়। অবশেষে রাজকীয় নৌবহরে করে অজস্র অমাত্য ও সৈন্যসামন্তসহ সুবাদার ইসলাম খান ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। সুবাদারের সম্মানার্থে তিনি পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত উল্লসিত জনতা জায়গাটির নাম ইসলামপুর বলে ঘোষণা করে। ঢাকায় পদার্পণের সময় সুবাদার অবস্থান করছিলেন তাঁর শাহি বজরা চাঁদনীতে, আর তাঁর জেনানারা ছিলেন আরেক শাহি বজরা ফতেহ্ দরিয়ায়।
নতুন দায়িত্ব নিয়ে দিল্লি থেকে ঢাকা ভ্রমণের চমকপ্রদ ঘটনাবলির স্মৃতি নিয়ে একটি কিতাব রচনা করছেন ঢাকায় আসা মোগল বাহিনীর অন্যতম সিপাহসালার আলাউদ্দীন ইস্পাহানি ওরফে মির্জা নাথান। তাতে ঢাকাবাসের অভিজ্ঞতাও লিপিবদ্ধ করা হবে। প্রথম আলোর প্রতিনিধির সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় মুগ্ধ সিপাহসালার হূদয়ের মুগ্ধতা অকপটে ব্যক্ত করে বলেন, এমন স্বচ্ছতোয়া নদনদীবিধৌত, মনোরম বৃক্ষশোভিত ও পাখির কূজনমুখরিত মুলুক তিনি আগে কখনো দেখেননি। এ দেশে না এলে জীবনে একটি সুমধুর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বঞ্চিত হতেন। ঢাকার অপার সৌন্দর্যে অভিভূত হওয়ার কারণেই তিনি তাঁর স্মৃতিধর্মী কিতাবটিতে ঢাকার অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মসলিন বস্ত্রের উত্পাদন, তদারকি ও উত্কর্ষ বিধানের জন্য মোগল প্রশাসন সরাসরি ভূমিকা রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সুবা বাংলার নতুন রাজধানীর প্রশাসনিক দপ্তরের নির্ভরযোগ্য সূত্রের এক তথ্যে জানা গেছে, অচিরেই এ কাজ দেখাশোনার জন্য একটি সরকারি পদ সৃষ্টি করা হবে।
ঢাকাকে সুবা বাংলার রাজধানী ঘোষণা করার পর মানুষ যখন আনন্দ উদ্যাপন করছে, দোলাই নদীসংলগ্ন এলাকার বসতিগুলিতে মানুষজন তখন অতিষ্ঠ হয়ে দিন যাপন করছে। পরিত্যক্ত নানা বর্জ্য, গবাদিপশুর মৃতদেহসহ নানা দূষিত পদার্থে দোলাই নদীর পরিবেশ সম্প্রতি সঙ্গিন হয়ে উঠেছে।
গতকাল সন্ধ্যার পর চাঁদনীঘাটের শাহি বজরা চাঁদনীতে কাঞ্চনীদের মুজরা বসেছিল। ঢাকায় আসার দীর্ঘ পথশ্রমের রংদার সেই মেহফিলে সুবাদার ইসলাম খান চিশতি তাঁর মনের শ্রান্তি দূর করেন। বাংলার ভূঁইয়াদের দমনে ব্যস্ত সুবাদার ও তাঁর আমির-ওমরাহ্, দেওয়ান-বকশি ও সিপাহসালারেরা অসংখ্য যুদ্ধবিগ্রহ ও দীর্ঘ যাত্রা শেষে ঢাকায় এসে পদার্পণ করেন। যাত্রা সফলভাবে সমাপ্ত হওয়ায় দিলখোশ সুবাদার তাঁর ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের সম্মানে এ মুজরার আয়োজন করেন। মেহফিলে দেওয়ান, ওমরাহ্, কাজিসহ উচ্চপদস্থ সব রাজকর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। ঢাকার কয়েকজন জমিদার ও বড় বণিককেও সে আসরে দাওয়াত করা হয়েছিল।
বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়ালে দৃশ্যপট সেই আগেরই মতো। নদীর স্বচ্ছ টলটলে স্রোতোধারা বয়ে চলেছে অবিরাম। ওপারে যত দূর চোখ যায়, ধানখেতের অবিশ্রাম সবুজ ঢেউ মন জুড়িয়ে দেয়। খটকা লাগে কেবল নদীর বুকে নানা কিসিমের নৌকার অত্যধিক আগমন দেখে। সে খটকা দূর করতে হলে নদীর দিকে পেছন ফিরে পারের দিকে তাকাতে হয়। গত দু-তিন দিনে ভোজবাজির মতো বদলে গেছে বুড়িগঙ্গার পার। বাংলার নতুন সুবাদার আলিশান বহর নিয়ে ঢাকায় তশরিফ রেখেছেন। তাঁর পাইক, বরকন্দাজ, মাহুত ও ঘোড়সওয়ারেরা বুড়িগঙ্গার চিরাচরিত রং ও বাহার একেবারে পাল্টে দিয়েছেন। দিল্লির একটি মহল্লা যেন জাদুবলে ঢাকার বুকে এসে নেমেছে।
সুবা বাংলার নবনিযুক্ত সুবাদার শেখ আলাউদ্দীন ইসলাম খান চিশতি তাঁর বিশাল নৌবহর নিয়ে ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থান করছেন। সুবাদারের মুখপাত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ঢাকায় বসবাসের জন্য কোনো আবাসিক ভবন নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত সুবাদার আপাতত তাঁর শাহি বজরা চাঁদনীতেই দিন গুজরান করবেন। পাকুড়তলী থেকে প্রায় এক ক্রোশ পশ্চিম-দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার ঘাটে সুবাদারের চাঁদনী বজরা স্থায়ীভাবে নোঙর করানো হয়েছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, এটি এখন থেকে সুবাদারের খাস ঘাট হিসেবে ব্যবহূত হবে। সুবাদারের শাহি বজরার নামানুসারে ঘাটটির নাম দেওয়া হয়েছে চাঁদনীঘাট।